
মাজিদ আমার বন্ধু। সিডনির ইউটিএসের গবেষক এবং শিক্ষক। তাঁর আমন্ত্রণে এইবার প্রথম বারের মত ইরানের মাসাদ শহরে একটি ক্যানসার কনফারেনসে কিনোট টক দিতে গিয়েছিলাম।
দুবাই থেকে মাসাদ এয়ারপোর্টে নেমেই ইরান সম্বন্ধে এতদিনের লব্ধ ধারণাতে একটু অবিশ্বাসের হাওয়া লাগা অনুভব করলাম। মনে হলো এমন ইরানের গল্পতো শুনিনি। ঝকঝকে এয়ারপোর্ট, প্রচুর টুরিষ্ট বেশির ভাগেই মূলত আরব এবং ইরাকি। মাসাদ শহরে এই বিশেষ শ্রেণির টুরিষ্টদের এত আগমনের কারণটি ঘন্টা তিনেক পরেই বুঝতে পেরেছি। মাসাদ হলো ইরানের অন্যতম প্রধান আধ্যাত্মিক শহর। এই শহরে ইমাম রেজার মাজার অবস্থিত। তিনি শিয়া মুসলমানদের অষ্টম ইমাম। যাঁকে টুস শহরে আব্বাসিয়া খলিফা আল-মামুন বিষ পান করিয়ে হত্যা করেছিলেন। এই টুস শহরে কিন্তু আরেক বিখ্যাত মানুষ ফেরদৌসীর জন্ম। যিনি শাহানামেহ মহাকাব্যের জন্য বিশ্ববিখ্যাত।
৮০০ শতাব্দীর শুরুর দিকে খলিফা মামুন নানাবিধ রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সমস্যার মুখোমুখি হয়েছিলেন। এসব সমস্যার মধ্যে অন্যতম ছিলো শিয়া সম্প্রদায়ের বিদ্রোহ। তিনি শিয়াদের বিদ্রোহ দমনে কৌশল হিসাবে ইমাম রেজাকে ব্যবহার করেছিলেন- তিনি ঘোষণা দিলেন তাঁর অবর্তমানে ইমাম রেজা খিলাফতের উত্তরাধিকারী হবেন। শিয়ারা ছিল ইমাম রেজার ভক্ত। ইমাম রেজা খিলাফতের মালিক হবেন এই কথা শুনে শিয়ারা বিদ্রোহ থামিয়ে দিল। কিন্তু এটি ছিল একটি প্রলোভন মাত্র।
আমার দেখা ইরান
কিছুদিনের মধ্যেই খলিফা মামুন খেয়াল করলেন যে তার নিজ সাম্রাজ্যে তার চেয়ে ইমাম রেজাকেই মানুষ অধিক সমীহ করে। সাধারণ মানুষ খলিফার চেয়ে ইমাম রেজাকেই বেশি গুরুত্ব দিতে শুরু করলো। তাঁর জনপ্রিয়তা দিন দিন আকাশচুম্বি হতে লাগলো। আর এটা খলিফা মামুন কীভাবে মেনে নিবেন? তিনি তখন প্রায় অর্ধ পৃথিবীর মালিক – শাহেনশাহ। শিয়াদের বিশ্বাসমতে খলিফা মামুন ইমাম রেজাকে বিষ পান করিয়ে হত্যা করে রাজনৈতিক সুবিধা নেওয়ার পাশাপাশি তাদের ধর্মীয় নেতাকেও পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিয়ে তাদেরকে নেতৃত্বহীন করে দিয়েছিলেন।
তাঁকে কবর দেওয়া হলো টুস শহর থেকে ১০০ কিলোমিটার দূরে বর্তমান মাসাদ শহরে। তিনি একমাত্র ইমাম যাঁর মাজার সৌদি বা ইরাকের বাইরে অবস্থিত।
তবে যা বলতে শুরু করেছিলাম, মাসাদ শহর এবং চারপাশের রাস্তাঘাট দেখে আমার চোখ কপালে ওঠার অবস্থা। আমি কখনও ভাবিনি ইরানের রাস্তা ঘাট এত পরিছন্ন এবং এতটা গোছানো হবে। ভেবেছিলাম ইন্ডিয়া বা মালয়েশিয়ার মত হবে হয়তো। যদিও রাস্তা ঘাটে সবাই নিয়ম মেনে ড্রাইভ করছে না- লেইন মেন্টেইন না করেই দ্রুত গতিতে সবাই চলছে, কিন্তু এর পরেও খুব খেয়াল না করলে এই অনিয়মটুকুও চোখে পড়বে না।
এয়ারপোর্ট থেকে শহরে ঢুকতে ঢুকতে আশ পাশ দেখে এতই মুগ্ধ হয়ে গেলাম যে, হোটেলে ঢুকেই দ্রুত ফ্রেশ হয়েই বেড়িয়ে গেলাম শহর দেখতে। আমার সাথে নিরাপত্তার জন্য সার্বক্ষণিক একজন ড্রাইভার এবং একজন দোভাষী দেওয়া হল। আমার টার্গেট ইমাম রেজার মাজার এবং আশেপাশের ঐতিহাসিক স্থানগুলো দেখা। প্রায় ১২০০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়েই একটুও না ঘুমিয়ে ছুটলাম এই মাজার দেখতে যা ১৯৭৯ সালে ইরানের ইসালামী বিপ্লবের পর আয়তনে অনেক বড় করা হয়েছে। কঠিন নিরাপত্তার বেষ্টনী পেরিয়ে মূল ইয়ার্ডে ঢুকেই দেখলাম মুগ্ধ হয়ে দেখার মত কারুকার্যময় সব স্থাপনা। মূল কবরস্থানে পৌঁছতে লাগলো প্রায় ৩০ মিনিটের মত। চারদিকে হাজার হাজার শিয়া ধর্মাবলম্বী মানুষ।
আমার দেখা ইরান
কী মিনার! কী দেয়াল! গোল্ডেন মিনার মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে এবং মিনারের কারুকাজ; দেখার মত দৃশ্য। আমার গাইড আমাকে বললো, “এসো তোমাকে একদম করবস্থান দেখিয়ে আনি, তোমার দেখে ভালো লাগবে”।
কবরস্থানের পাশে গিয়ে দেখি শত শত মানুষ কোরান পড়ছে। বাংলাদেশের মত আগরবাতি বা মোমবাত জ্বালিয়ে চারপাশ নোংড়া করছে না। চারদিক ঝকঝকে, জ্বলমল করছে। এত আলোকিত থাকার আরেকটি কারণ- মূল কবরটি একটি বিরাট মসজিদ আকৃতির ঘরের ঠিক মাঝখানে। আর ঘরটির প্রতিটি ইঞ্চি পার্সিয়ান কারুকাজে সজ্জিত। এই কারুকাজগুলোতে প্রচুর চতুষ্কোণ আকৃতির আয়না ব্যবহার করা হয়েছে (শুনেছি এই আয়নাগুলো পার্সিয়ানদের স্পেশাল। শুধু ইরানের ইস্পাহান নগরের বিশেষ এক শ্রেণির কারিগরেরাই এই চতুষ্কোণ আকৃতির আয়না গুলো বানাতে পারে। হাজার হাজার ছোট ছোট এমন আয়নাকে একটি একটি করে জোড়া লাগিয়ে এমন সব কারুকার্যময় আকৃতি তৈরী করা হয়েছে তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা প্রায় অসম্ভব)।