প্রায় বছর খানিক আগে প্রথম আলোতে ‘ভুবন মাঝি’ চলচ্চিত্রটি নিয়ে একটি লেখা পড়েছিলাম। পুরোটা মনে করতে না পারলেও লেখার মূল বিষয়টি এখনো মনে গেঁথে আছে। পুরো লেখাটি জুড়ে ছিল আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ের একটি গল্পের চিত্রায়ণের অপূর্ব বর্ণনা। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ কীভাবে দুজন অখ্যাত মানুষের জীবনকে বদলে দিয়েছিল তার কথা বলা হয়েছিল। তথ্য হিসেবে আরও দেওয়া হয়েছিল, ছবিটি সরকারের অনুদানে নির্মিত হচ্ছে। পরিচালনা করছেন ফখরুল আরেফিন। ছবিটিতে নায়ক চরিত্রে কলকাতার পরমব্রত চট্টোপাধ্যায় ও নায়িকা চরিত্রে অপর্ণা ঘোষ অভিনয় করছেন। তখন থেকেই ছবিটি দেখব বলে স্থির করে রেখেছিলাম।
গতকাল ব্রিসবেনে এই ছবিটি প্রদর্শিত হলো। ছবির পুরো সময়টি জুড়ে আমি সেই চিত্রায়ণ খুঁজেছিলাম। যদিও অসম্ভব ভালো কিছু দৃশ্যধারণ ছিল। যেমন মানুষের দেশ ছেড়ে যাওয়ার দৃশ্য, পাকশী ব্রিজ আর রেললাইনের ওপর নহির আর ফরিদার বসে থাকার দৃশ্য। ভালো কয়েকজন অভিনেতা ছিলেন—পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়, অপর্ণা ঘোষ, মাজনুন মিজান ও মামুনুর রশীদ। কয়েকটি ভালো গান ছিল। এর পরেও ছবিটিতে প্রত্যাশার অনেক কিছুই খুঁজে পাইনি। এই ছবিটিকে আমি আমার দেখা মুক্তিযুদ্ধের কাহিনির ওপর নির্মিত মুভিগুলোর একদম নিচের দিকে স্থান দেব।
ছবিটি শেষ হতেই প্রথম যে কথাটি মনে এল, এর নাম ভুবন মাঝি কেন হলো? আমাদের কি পুরো ছবিটি দেখানো হয়নি? কোনো অংশ কি বাদ পড়েছে? কুষ্টিয়ার আনন্দ সাঁইয়ের সঙ্গে ভুবন মাঝির সংযোগটি কোথায়? কাহিনির কোথাও এই নামকরণের সঙ্গে কোনো যোগ পেলাম না। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে পাকিস্তানি হানাদার এবং তাদের এ দেশীয় দোসরদের ভয়াবহ পাশবিকতা, মুক্তিযুদ্ধে বীরাঙ্গনা প্রেমিকাকে খুঁজে পাওয়ার আকুতি নিয়ে বছরের পর বছর অপেক্ষা করা, বাউল হয়ে যাওয়া—এটি অপূর্ব সুন্দর একটি প্লট। প্লটের সেই অংশের সঙ্গে ভুবন মাঝি নামকরণের কোনো সংযোগ পেলাম না। তাহলে নামটি কি প্রতীকী? হবে হয়তো। হলেও আমি ধরতে পারিনি।
ভুবন মাঝি চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্য। সংগৃহীত
তিনটি ভিন্ন টাইমলাইনে ছবিটি প্যারালাল চলেছে—১৯৭১, ২০০৪ ও ২০১৩। ১৯৭১ থেকে ২০১৩ সালের বিস্তৃত ইতিহাসে একটি ভয়াবহ গণহত্যা ছিল, নহিরের মুক্তিযুদ্ধে আসার কাহিনি ছিল, তার মানবিকতা ছিল, তার সংস্কৃতির কথা ছিল। তার প্রেয়সীর কাহিনি ছিল। তার পরিবারের, বন্ধুর কাহিনি ছিল। ভারতের সহযোগিতার কাহিনি ছিল। পরিচালক চেষ্টা করেছেন একটি কানেকশন আনতে। আর তা করতে গিয়ে মাঝে মাঝেই খেই হারিয়ে ফেলেছেন। কিছু কিছু জায়গায় শুধু পরমব্রত আর অপর্ণার কারণে পার পেয়ে গেছে। ঠিক কয়েকজন আবার ডুবিয়ে দেওয়ার কাজটিও করেছেন ভালোমতো। মাজনুন মিজান এত দিন ধরে অভিনয় করেন, অথচ এই মুভিতে অনেকগুলো দৃশ্যকে তিনি ডুবিয়ে দিয়েছেন। ভাসমান নৌকায় ধর্ষক রাজাকারকে মারার দৃশ্যটি পরমব্রতের কারণে বেঁচে গেলেও, প্রতিশোধের তীব্রতা পেলাম না। প্রেমিকার ধর্ষক কুখ্যাত রাজাকার চোখের সামনে বসা। যে বীভৎসতায় সে ধর্ষণ করেছিল একটি ফুলের মতো নিষ্পাপ মেয়েকে তার চেয়ে সহস্র গুণ বেশি তীব্র প্রতিশোধ আশা করেছিলাম। গুলি করে মেরে ফেলার নাম প্রতিশোধ না (কাহিনির শেষে বুঝতে পারলাম এই গুলি খাওয়া রাজাকারটি এখনো বেঁচে আছে)। আরও দুজন ছিলেন ২০০৪ সালের প্রেক্ষাপটে। লম্বা চুলওয়ালা একজন ও তার বান্ধবী। তারা যে কয়টা দৃশ্যে এসেছেন সব কয়টিকে ডুবিয়ে একদম গন্ধ ছড়িয়ে গেছেন।
চোখে লাগার মতো একটি দৃশ্য ছিল মামুনুর রশীদের (বড় হুজুর) এবং তার সাগরেদের নকল দাঁড়ি। এই রকম নকল দাঁড়ি লাগিয়ে এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রকে দৃষ্টিকটু না করলেও ভালো হতো। আরও একটি কাজ করা হয়েছে খুব অদক্ষভাবে। সীমান্তের ওপারের ক্যাম্পের হাসপাতালের দৃশ্যটি। পরিচালক বা স্ক্রিপ্টরাইটার কোথায় পেলেন এমন ক্যাম্পের দৃশ্য! এমন হাসপাতালের দৃশ্য! আরও আছে। নদীর ওপারে মশাল হাতে মানুষের দৌড়াদৌড়ির দৃশ্যটি কি আরও বিশ্বাসযোগ্য করানো যেত না? মশাল হাতে একের পর এক বাড়িতে আগুন দেওয়া হচ্ছে—সেই বীভৎসতা কোথায়? দৃশ্যে বিশ্বাসযোগ্যতা কোথায়? নদীর এপার থেকে দেখছে বলে মশালের আলো এক জায়গায় ঘুরতে থাকবে? সবচেয়ে কাছেরটি একটু স্পষ্ট এবং সবচেয়ে দূরের মশালটি অস্পষ্ট থাকবে—বাস্তবে এমনটিই হওয়ার কথা। সবগুলো এক থাকবে না। পুথি পড়ার কয়েক সেকেন্ডের ছোট দৃশ্যটি আরেকটির উদাহরণ। এই রকম অনেক ছোট বড় অনেক দৃশ্যে অনভিজ্ঞতা এবং তাড়াহুড়া স্পষ্ট ধরা পড়েছে।
মানুষ খুন করা কোনো স্বাভাবিক পর্যায়ের কাজ না। অনেকেই তা পারে না। যুদ্ধের প্রয়োজনের সময়ও পারে না। কিন্তু এই কঠিন সত্যটি শুধু ডায়ালগ ছাড়া মুভিতে কোথাও তেমন আসেনি। গ্রেনেড ছোড়ার দৃশ্যটি দিয়ে নহির চরিত্রের এই অংশটি বোঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে—আমার মতে এটিও ছিল খুব দুর্বল একটি দৃশ্য। নহিরের কলকাতায় যাওয়া, আকাশবাণী অফিস খুঁজে বের করা, ট্রাকের ওপর দাঁড়িয়ে অদম্য মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিনিধি হিসেবে কুষ্টিয়ার পাকিস্তানি হানাদারদের হামলার বর্ণনা—এই দৃশ্যগুলো এত দুর্বল হওয়ার দায় কিন্তু পরিচালককে নিতে হবে। এইগুলো ইচ্ছে করলেই খুব প্রাণবন্ত এবং বাস্তবের কাছাকাছি নিয়ে আসা যেত।
ব্রিসবেনে ভুবন মাঝির প্রদর্শনীতে দর্শক
কুষ্টিয়া শহরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যে হত্যাযজ্ঞ করেছে, তাদের দোসররা যে হত্যা এবং ধর্ষণের খেলায় মেতেছিল—তার টান টান উত্তেজনা কোথায়? মুক্তিযুদ্ধের ছবি দেখে কাঁদিনি এমন কখনো হয়নি। উদভ্রান্ত হইনি তা কখনো হয়নি। একটি ঘটনা বলি, ১৯৯৭ সালে ‘আগুনের পরশমণি’ দেখে সিলেটের নন্দিতা সিনেমা হল থেকে বের হয়েই আমি এবং আমার প্রয়াত বন্ধু বিজন (কয় বছর পরে সে গলার ক্যানসারে মারা গেছে) হলের পাশের চা দোকানে চুলায় ঠেলে দেওয়া জ্বলন্ত কাঠের লাকড়ির দুই টুকরো দুজনে এক টানে হাতে নিয়ে হাঁটা শুরু করেছিলাম। চোখে মনে মগজে ছিল রাজ্যের হিংস্রতা। যদি একটি চিহ্নিত রাজাকার হাতের কাছে পেতাম সেদিন পিটিয়েই মেরে ফেলতাম, এমন ছিল মনের অবস্থা! কই ভুবন মাঝি দেখে আমার মনতো সেভাবে বিদ্রোহ করে ওঠেনি। কেঁদে ওঠেনি। আমার চোখ ভিজে যায়নি। কিন্তু এই মুভির প্লটটি ছিলতো ভাসিয়ে নেবার মতো। চিন্তা করা যায়, একজন সংস্কৃতিপাগল যুবক যে কিনা নাটক এবং প্রেমিকা ছাড়া কিছুই করতে পারত না, সে গেরিলা যোদ্ধা হলো। মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় (বর্তমানে মুজিবনগর) বাংলাদেশ সরকারের আনুষ্ঠানিক আত্মপ্রকাশ এবং ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি ও মন্ত্রিপরিষদের সদস্যদের শপথ অনুষ্ঠানে জাতীয় সংগীত গাইল। তার প্রেমিকাকে রাজাকারেরা ধর্ষণ করল। হারিয়ে যাওয়া সেই বীরাঙ্গনা প্রেমিকার জন্য প্রতীক্ষায় থেকে থেকে বাউল হয়ে এক জীবন কাটিয়ে দিল—কী চমৎকার সব বাঁক। এই কাহিনির মুভি এমন নিষ্প্রভ কেন হবে?
আর ছবির ডায়ালগের কথা কি বলব। পরমব্রত ও অপর্ণা ছাড়া বাকিদের মুখ খুলতেই মনে হয় এই বুঝি ডুবল! ক্যামেরায় লাশের ছবি তোলার দৃশ্যের সময় মেয়েটির সঙ্গে মোল্লাদের ডায়ালগ ছিল খুব দুর্বল মানের। মেয়েটিরও। মেয়েটির বন্ধু—মোটরসাইকেল চালক ছেলেটিকে এখানে আনা উচিত হয়নি। তার সিগারেট টানার দৃশ্যটিও ছিল খুব বাজে। অল্প কয়েকটি দৃশ্যের এই চরিত্রটির জন্য অভিনয় জানে এমন কাউকে আনা উচিত ছিল।
পুরো ছবিতে অপূর্ব কিছু দৃশ্যধারণের পাশাপাশি ভালো লাগার মতো যা ছিল তা হলো কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্যের সুর ও সংগীতায়োজন। ছবিটির একটি বাদে সব কটি গানের সুর ও সংগীতায়োজন করেছেন তিনি। তার নিজের কণ্ঠের ‘আমি তোমারই নাম গাই’, পরমব্রতের কণ্ঠে ‘পদ্মা নদীর নৌকা ভিড়ল’—এই দুটি গান এবং পরমব্রত ও অপর্ণার অভিনয় কোনো রকমভাবে এই ছবিটিকে বাঁচিয়ে রেখেছে। অথচ এমনটি হওয়ার কথা ছিল না। এই গানগুলোর সঙ্গে ছবির কাহিনি দর্শকদের টানার কথা ছিল। ১৯৭১ সালের গণহত্যার ভয়াবহতা ঠেলে একজন অতি সাধারণ মানুষের সংগ্রাম, লড়াই, প্রতীক্ষা, মানবিকতা ফুটে ওঠার কথা ছিল। হয়নি।
এর পরেও ছবির পরিচালক এবং সংশ্লিষ্ট সকলকে ধন্যবাদ সদ্য প্রয়াত কালিকাপ্রসাদকে ছবিটি উৎসর্গ করার জন্য। আরেকটি কথা এখানে না বললে খুব অন্যায় হবে। বাংলাদেশের নির্মিত ছবি ব্রিসবেন শহরের কোনো থিয়েটারে বসে পরিবারের সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে উপভোগ করার ব্যবস্থা করাটা মোটামুটি সাহসের একটি কাজ। অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জটি এখানে মুখ্য থাকে। এই সাহসী কাজটি করার জন্য বাপ্পী হোসাইন ও তুলি নূরকেও ধন্যবাদ ।
ব্রিসবেনে ভুবন মাঝির প্রদর্শনীতে দর্শক