Shiddiky Laboratory
Back to Writings
October 20, 2019
শহীদুল: ব্রিসবেন কাঁদছে তোমার জন্য
অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী শহীদুল ইসলামের অকালমৃত্যুতে লেখকের শোক
Featured in
The Daily Prothomalo
শহীদুল: ব্রিসবেন কাঁদছে তোমার জন্য

সেদিন বিকেলে দুটি ক্লাস ছিল। ক্লাস শেষে গাড়িতে করে বাড়ি ফিরছি। একটি সিগন্যালের লালবাতিতে দাঁড়িয়ে আছি। সিগন্যাল সবুজ হতেই যেই চলতে শুরু করব, তখন দেখলাম আমার বাঁ পাশের লাল সিগন্যাল উপেক্ষা করে একটি গাড়ি পুরো গতিতে আমার দিকে এগিয়ে আসছে। আমি কী করব না করব ভাবতে ভাবতেই বিকট এক শব্দ হলো। প্রচণ্ড একটি ঝাঁকুনি খেলাম। দেখলাম আমার গাড়ির সামনের বাঁ পাশটি দুমড়েমুচড়ে দিয়ে সেই গাড়িটি আমার সামনে আছড়ে পড়ল।

আমি গাড়ির ভেতরে আটকে গেলাম। দুই–তিনবার বাইরে আসতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু কোনোভাবেই দরজা খুলতে পারলাম না। ট্রিপল জিরোতে কল করলাম। টেলিফোনের ওপর প্রান্তের নারী একটির পর একটি প্রশ্ন করে যাচ্ছিলেন। আমি কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিলাম। তারপর আর কিছুই মনে করতে পারছিলাম না।

অনেক পরে যখন পুরোপুরি বুঝতে পেরেছিলাম তখন নিজেকে আবিষ্কার করলাম হাসপাতালে। বিধাতার অশেষ রহমতে এই দুর্ঘটনায় আমার শরীরে কোনো আঘাত লাগেনি। আমি অক্ষত থেকে গেলাম। বিধাতা আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু দুর্ঘটনার পর প্রায় ঘণ্টাখানেক আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। সম্ভবত আমি একটি ট্রমার মধ্যে পড়ে গিয়েছিলাম।

এ ঘটনা ঘটে এই বছর ১৯ আগস্টে। সেদিন হাসপাতালের চিকিৎসক যখন এমআরআই এক্স-রে করছিলেন, তখন এসবের ফাঁকে আমি নিজে ফোনে বাসায় কথা বললাম। তাদের আশ্বস্ত করলাম, আমার তেমন কিছুই হয়নি।

তবে দুই সন্তান রিদা ও ইওয়ান বারবার ফোন দিচ্ছিল। তারা বুঝতে চেষ্টা করছিল, আমার দুর্ঘটনা কেন এবং কীভাবে হয়েছে। আমি কখন বাড়ি ফিরব।

হাসপাতালে থাকা অবস্থায় আমি মনে মনে ঠিক করেছিলাম, কোনোভাবেই আমার দুর্ঘটনার খবর এই মুহূর্তে দেশে আমার আম্মা–আব্বা ও ভাইবোনদের দেওয়া যাবে না। তাঁদের জানানো যাবে না যে আমি দুর্ঘটনায় পড়ে হাসপাতাল পর্যন্ত গিয়েছিলাম। তাঁরা সবাই আমাকে অসম্ভব ভালোবাসেন। আমার এই সংবাদে তাঁরা অস্থির হয়ে যাবেন, আতঙ্কের পড়ে যাবেন। বিশেষ করে আমার বৃদ্ধ আম্মা–আব্বা এই সংবাদে ট্রমার মধ্যে পড়ে যেতে পাড়েন।

মৃত্যুর খুব কাছে থেকে আমি ফিরে এসেছি। আমি জানি, সেই বিকট শব্দ ও ঝাঁকুনির স্মৃতি মন আর মগজ থেকে কিছুতেই সরাতে পারব না।

দুই.

১৬ অক্টোবর ২০১৯ বুধবার। অন্য সব দিনের মতো বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি। নাশতা করছি। আমার স্ত্রী বললেন, টিভি খোলো। নিউজ দেখো। ভয় আর আতঙ্ক তার চোখমুখে। চ্যানেল সেভেনের নিউজটি দেখে নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। ব্রিসবেনের পরিচিত মুখ শহীদুল ইসলাম সড়ক দুর্ঘটনায় ঘটনাস্থলে প্রাণ হারিয়েছেন।

মঙ্গলবার মধ্যরাতে তিনি উত্তর ব্রিসবেনের গিম্পি আর্টেরিয়াল রোড ধরে গ্রিফিন থেকে বাড়ি ফিরছিলেন। আর এখানেই তাঁর গাড়ির সঙ্গে উল্টো দিক থেকে বেপরোয়া গতিতে আসা এক গাড়ির সংঘর্ষ হয়। অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন টেলিভিশনে প্রচারিত সংবাদের তথ্যমতে, চুরি করে আনা একটি মিতসুবিশি চ্যালেঞ্জার ফোর উইল গাড়ি নিয়ে চোর ও তার এক সঙ্গী অবৈধভাবে ভুল পথে শহীদুলের মুখোমুখি বেপরোয়া গতিতে এগিয়ে আসছিল। গিম্পি আর্টেরিয়াল রোডেই সে শহীদুলের গাড়ির সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। সঙ্গে সঙ্গেই প্রাণ হারান শহীদুল।

সেদিন শহীদুলের জানাজায় উপচে পড়া মানুষের ঢল নেমেছিল। আমি আমার প্রায় দেড় যুগের বিদেশ জীবনে জানাজায় এত মানুষ খুব কম দেখেছি। কমিউনিটির সর্বস্তরের মানুষ জানাজায় শরিক হয়েছেন। বুক ফেটে কেঁদেছেন অনেকেই। বিষণ্ন মনে অনেককে হা–হুতাশ করতে দেখেছি।

আমি খুব দুর্বল মনের মানুষ। জীবনে আমি কখনো কারও লাশ দেখিনি। কিন্তু সেদিন কেন জানি শহীদুলের লাশ দেখতে গেলাম! মসজিদের সামনে তাঁকে কফিনে রাখা হয়েছিল। কী গভীর ঘুমেই না তিনি ঘুমিয়ে ছিলেন। মনে হচ্ছিল, এই বুঝি জেগে উঠবেন! তাঁকে শেষ দেখা দেখে যেই বাইরে এলাম, আমার বুক ফেটে কান্না চলে এল। এই কান্নাটা ছিল ভয়ের। অনিশ্চয়তার। আতঙ্কের।

এই তো সেদিন আমিও প্রায় শহীদুলের মতোই এক অনন্ত গভীর ঘুমে তলিয়ে যাওয়ার পথেই ছিলাম! মাত্র সেকেন্ডের ব্যবধানে বেঁচে গেলাম। বিধাতা হায়াত রেখেছিলেন বলেই সেদিন বেঁচে গিয়েছিলাম।

তিন.

শহীদুলের এই চিরপ্রস্থানের মাত্র ৯ দিন আগে, ৭ অক্টোবর ২০১৯ তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। ব্রিসবেন কমিউনিটির এক বড় ভাইয়ের মেয়ের বিয়েতে। সেই বিয়ের দাওয়াতে অনেক মানুষ এসেছিলেন। আমরা যে টেবিলে বসেছিলাম সেই টেবিলেই শহীদুল, তাঁর স্ত্রী ও চার বছরের প্রিয় সন্তানকে নিয়ে বসেছিলেন। আমার সঙ্গে টুকটাক ভালোমন্দ কথা হয়েছিল।

তাঁর দুর্ঘটনার কথা শোনামাত্র নিজেকে কিছুতেই বোঝাতে পারছিলাম না। বারবার তাঁর হাসিমাখা মুখের ‘ভাই, অনেক দিন পর দেখা, কেমন আছেন?’ কথাটি এখনো কানে বাজছে। তাঁর সঙ্গে এমন দাওয়াত ও ক্রিকেট খেলার মাঠ ছাড়া আমার তেমন দেখাও হতো না।

শহীদুল উত্তর ব্রিসবেনের গ্রিফিনে তাঁর পরিবারের জন্য স্বপ্নের একটি বাড়ি বানিয়েছিলেন। বাড়ির কাজ মাত্র শেষ করেছিলেন। নতুন বাড়িতে নতুন ফার্নিচার আনবেন। সেই বাড়ি থেকেই তাঁর ছেলের ফ্রি প্রাইমারি স্কুল শুরু করবেন। প্রাথমিক কিছু পরিচ্ছন্নতার কাজের জন্যই সেদিন সন্ধ্যারাতে তিনি গ্রিফিনের নতুন বাড়িতে গিয়েছিলেন। তাঁর স্ত্রী–সন্তানকে বলে গিয়েছিলেন খুব তাড়াতাড়িই ফিরে আসবেন। কিন্তু তাঁর আর সেখান থেকে ফিরে আসা হয়নি। এসেছেন তবে জীবিত নয়, লাশ হয়ে। আমাদের জীবন কত ঠুনকো!

আমার খুব ইচ্ছে ছিল তাঁর দাফনে অংশ নেব। কিন্তু সাহস করে যেতে পারিনি। আমি আবার খুব আবেগপ্রবণ মানুষ। একবার চিন্তা করুন চার বছরের একটি সন্তান তার বাবার চিরপ্রস্থান চেয়ে চেয়ে দেখছে! কেউ একজন তার হাতে এক মুঠো মাটি তুলে দিয়েছে তার বাবার কবরে দেওয়ার জন্য। সে ছোট্ট হাতে সেই মাটি কবরের ওপর ছড়িয়ে দিচ্ছে। অন্য কেউ পারলেও আমি এই দৃশ্য দেখে ঠিক থাকতে পারব না।

এই অবুঝ শিশুটি বুঝতেই পারছে না যে তার বাবা আর কখনো ফিরে আসবে না। তাকে কেউ কখনো আর তেমন করে বুকে জড়িয়ে ধরবে না! তার সঙ্গে খেলবে না। সে কিন্তু জানে যে তার বাবা তাদের নতুন বাড়ি পরিষ্কার করতে গিয়েছেন। চলে আসবেন, সে অপেক্ষায় আছে! দাফনের ভিড়ের মধ্যে সে হয়তো অপেক্ষায় থাকবে তার বাবা আশপাশে কোথাও আছেন! যেকোনো মুহূর্তে হাসি হাসি মুখে তার দিকে দুই হাত তুলে এসে বুকে জড়িয়ে ধরবেন! এভাবে সারা জীবনেই হয়তো সে অপেক্ষায় থাকবে।

চার.

নিরাপদ জীবনের আশায় আমরা অনেকেই দেশ ছেড়ে বিদেশকে ‘দেশ’ বানিয়েছি। নিরাপদ, সুখী, আর সমৃদ্ধ জীবনের আশায়। সেই ‘নিরাপদ’ দেশ যদি এভাবে জীবন কেড়ে নেয়, তখন সত্যি অসহায় অনুভব করি। জানি, এটি একটি নিখাদ দুর্ঘটনা। শুধু আমরা যাঁরা অন্য দেশ থেকে এসে এই দেশকে দেশ বানিয়েছি তাঁদের জীবনে না, এটি যে কারও জীবনেই হতে পারে। হচ্ছেও। শুনেছি এই রকম দুর্ঘটনার হার দিন দিন বেড়েই চলছে। কিন্তু এরপরও মানতে কষ্ট হয়। এভাবে কিছু ড্রাগ অ্যাডিক্ট চোরদের হাতে দিন দিন রাস্তা অনিরাপদ হতে থাকলে শহীদুলের মতো অনেক নির্দোষ নিরপরাধ বাবা, প্রিয়তম স্বামীর বলি হওয়ার মিছিল দিন দিন লম্বা হবে।

শহীদুলের মৃত্যুতে আমাদের ব্রিসবেন কমিউনিটিতে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। বিশেষ করে তাঁর বন্ধু এবং প্রিয়জনেরা খুব ভেঙে পড়েছেন। দেশে যেমন আমাদের আত্মীয়ের অভাব নেই। প্রিয়জনের অভাব নেই, গোষ্ঠীভিত্তিক গ্রামভিত্তিক কত আত্মীয়! আর বিদেশ–বিভুঁইয়ে আমরা যাঁরা প্রথম জেনারেশন বিদেশি তাঁদের কাছে বন্ধু ও পরিচিতজনেরাই আত্মীয়।

শহীদুলের এই অকালপ্রয়াণে তাঁর স্ত্রী ও সন্তানের পাশে সবাই দাঁড়িয়েছেন। যে নতুন বাড়িতে ওঠার জন্য তিনি সব আয়োজন সেরে গিয়েছিলেন, সেই নতুন বাড়িতে তাঁর স্ত্রী–সন্তান যাতে সারা জীবন থাকতে পারে, সে জন্য তাঁর বন্ধুরা ইতিমধ্যে ফান্ড রাইজিং শুরু করেছেন। এই কাজটি করতে এগিয়ে এসেছেন তাঁর বন্ধু ও প্রতিবেশী মেক্সি হক।

আমি খেয়াল করে দেখেছি, মেক্সিদের এই ফান্ড রাইজিংয়ে শুধু আমাদের প্রবাসী বাংলাদেশিরা না এখানকার নাগরিকেরাও অংশ নিয়েছেন। খুব দ্রুত টাকা উঠছে। আমাদের সবার উচিত, যে যার মতো করে এই ফান্ড রাইজিংয়ে অংশ নেওয়া। এই ছোট্ট ছেলেটির ভবিষ্যৎ যাতে অনিশ্চয়তায় না থাকে, তার জন্য তার পাশে দাঁড়ানো।

সবশেষে এখানকার সিস্টেমের ওপর একটি কথা বলি। আমি বিশ্বাস করি, এখানকার পুলিশ তাদের সর্বোচ্চ দিয়ে চেষ্টা করবে এই দুর্ঘটনায় আসল ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাঁড়াতে এবং দাঁড়াবেও। এরপরও এ দেশের একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে সরকারের প্রতি আমার অনুরোধ থাকবে আমাদের রাস্তাকে ১০০ ভাগ নিরাপদ রাখার সব রকমের উদ্যোগ নিন। এই রকম গাড়ি চোর ও দুই চারজন ক্রেজি মানুষের জন্য শত শত নিরপরাধ মানুষের জীবন বিপন্ন হতে পারে না।

Shiddiky Laboratory
Research
Publications
News
Future Member
Contact
Copyright © 2024 Shiddiky Laboratory. All Rights Reserved. Designed & Developed by@abdnahid_