আমি অনেক তরুণ শিক্ষকের সাথে মিশেছি, কথা বলেছি- এদের অধিকাংশই শিক্ষকতা জীবনে রাজনীতি করা পছন্দ করে না, বাধ্য হয়ে এতে নাম লেখায়। কারণ যারা শিক্ষক রাজনীতি করে না তারা দিনের পর দিন কোন গ্র্যান্ট পায় না, বাজেট পায় না।
আপনারা যারা বয়স্ক শিক্ষক আছেন (বিশেষ করে যারা রাজনীতি করেন) তাঁদের প্রতি বিনীত প্রার্থনা- দয়া করে একটু অফ যান। নিজের রাজনীতির ভাইরাস আর ছড়াবেন না। আপনি বেতন পান দৈনিক আট ঘন্টা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো, গবেষণা করা বা সার্ভিস দেওয়ার জন্য, অন্য কোন কিছু করার জন্য নয়। সকাল আটটা থেকে বিকাল চারটা পর্যন্ত আপনি বিশ্ববিদ্যালয়ে এই কাজগুলো করবেন বলেই জনগন তাদের ট্যাক্সের টাকা আপনাকে বেতন হিসাবে দেয়। অতএব আপনি এখন থামেন। আর ধ্বংস করবেন না। যারা নবীন শিক্ষক তাদেরকে রাজনীতি মুক্ত পরিবেশ তৈরী করার সুযোগ দিন।
যেসব বাংলাদেশি গবেষক বিদেশে একদম ফ্রন্টলাইনে রিসার্চ করছেন, তাঁরা কিন্তু দেশে গিয়ে কিছু করা তো দূরের কথা টিকেই থাকতে পারেন না। এর প্রধান কারণ- আমরা এখনও বাংলাদেশে রিসার্চ কালচারটি প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি। ইন্টেলেকচুয়াল পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারিনি। বলতে দ্বিধা নেই, পিএইচডি করানোর জন্য যে পরিমাণ ডেডিকেশান দরকার তা আমাদের মাননীয় অধ্যাপক বা সিনিয়র গবেষকদের নেই। যে পরিমাণ সময় একজন ছাত্রকে দেওয়া দরকার সেটি তাঁরা এখানে দেন না (এবং দেওয়াটিকে মূর্খতার সামিল মনে করে, লাল নীল সাদা কালো এসব দলে দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা বেশি মনে করেন )। সারা বছর কোন গবেষণায় না থাকলেও একটি ভালো কনফারেন্স করতে যান, দেখেন তাঁরা কত বড় বড় প্রতিবন্ধকতা তৈরী করেন (সমস্যা হচ্ছে এসব যে প্রতিবন্ধকতা তাই তারা মনে করেন না)। তাঁদেরকে আপনার অবশ্যই ইনভাইটেড স্পিকার করতে হবে! সেশান চেয়ার করতে হবে! তাঁরা যেভাবে বলেন সেভাবেই টাইম স্লট দিতে হবে। কনফারেন্সের মান নির্ভর করে দক্ষ, মানসম্পন্ন স্পিকার এবং প্রেজেন্টারের উপর। আর এর বারোটা বাজানোর ষোলআনা তাঁরা পূর্ণ করবেন সারা দেশে ছড়িয়ে থাকা তাঁদের বন্ধুদের বা অধীনস্তদের ইনভাইটেড স্পিকার এবং সেশান চেয়ারের জন্য ডেকে আনার চাপ সৃষ্টি করে।
বিদেশে আমরা যারা শিক্ষকতা করি বা গবেষণা করি প্রতি বছর আমাদের কি পারফরমেন্স ইন্ডিকেটর (কেপিআই) যাচাই করা হয় অনেকগুলো ক্রাইটেরিয়ার উপর ভিত্তি করে। এর মধ্যে কয়েকটি হলো আমরা বছরে কয়টি (কত) গ্র্যান্ট এনেছি, কয়টি পাবলিকেশান করেছি, কয়জন পিএইচডি বা মাস্টার্সের ছেলেমেয়েকে ডিগ্রী দিয়েছি! যার কেপিএই যত ভালো সে তত বেশি সুযোগ সুবিধা পাবে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালগুলোতে এই কালচারটি প্রথমে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এখানে বয়স কোন ফ্যাক্টর হবে না, এখানে রাজনীতি কোন ফ্যাক্টর হবে না। সব কিছু চুলচেরা বিচার হবে কেপিএইয়ের উপর ভিত্তি করে। যে যত বেশি গ্র্যান্ট আনবে, কোয়ালিটি পাবলিকেশানস করবে, পিএইচডি বা মাস্টার্সের ছাত্রের ডিগ্রী দিবে তাঁর বয়স যতই হোক, তিনি যেই পার্টিই করুন, যে লেভেলেই চাকুরি করুন (লেকচারার হোন আর অধ্যাপকই হোন) তাঁর মূল্যায়ণ থাকবে সবাই উপরে। এই কালচারটি প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
আর এই কালচারটি প্রতিষ্ঠা করতে প্রথম যে কাজটি করতে হবে, সেটি হলো শিক্ষক রাজনীতি বন্ধ করা। আর এই কাজটি করতে সবার আগে এগিয়ে আসতে হবে সরকারকে। এখন বলবেন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গত দুই দশকে বেশির ভাগ পলিটিক্যাল নিয়োগ হয়েছে। সুতারাং এদের দিয়ে আপনি শিক্ষক রাজনীতিমুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় কিভাবে আশা করবেন? এরা রাজনীতি করে কারণ এই কাজটি করলে কোন কিছু না করেও অনেক কিছু করা যায়। একজন লেকচারার হয়েও অধ্যাপক লেভেলের কাউকে ধমক দেওয়া যায়। সরকার যদি এদের পেছন থেকে তার আর্শীবাদ তুলে নেয়, দেখবেন এরা দল বেঁধে ক্লাসে যাচ্ছে, পড়াচ্ছে।
বিশ্ববিদ্যালয় যারা চালান তাদের স্পষ্ট বলে দিতে হবে প্রতিটি শিক্ষকের চাকুরির স্থায়িত্ব নির্ভর করবে তার বাৎসরিক কেপিআইর উপর। যার কেপিআই ভালো তিনি নিশ্চিন্তে থাকবেন। বিশ্ববিদ্যালয়ও তাঁর সাথে থাকবে। তার গবেষণা এবং শিক্ষকতার জন্য পারফর্মেন্স অনুসারে সহযোগিতা করবে- গ্র্যান্ট দেওয়ার মাধ্যমে, বিজ্ঞান সম্মেলন আয়োজনের মাধ্যমে, দেশে বিদেশে গবেষণাপত্র নিয়ে অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে। অন্যদের ভালো করানোর জন্য বিশ্ববিদ্যালয় পথ দেখিয়ে দিবে, ট্রেনিং দিবে। এইভাবে একবছর, দুইবছর সুযোগ দিবে। তার পরেও কোন উন্নতি না হলে তাঁদেরকে বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগ করতে বলবে (ভাববেন না, এরা রাজনীতি করবে- দল পাকাবে। আগে যদি শিক্ষক রাজানীতিটা বন্ধ করে দেন এরা কিছুই করার সাহস পাবে না। টু শব্দটিও করবে না। বরং ভালো গবেষণা করবে, ভালো পাবলিকেশানস করবে- সব কিছু ঠিক করে চলবে। কারণ এই শিক্ষকরাই বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যখন যান তখন ভালো কেপিআই নিয়ে বহাল তবিয়তে পড়ান, গবেষণা করেন।